ধর্মের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ধর্ম প্রসঙ্গে

যারা আমাকে চেনে, তারা হয়তো আমাকে সর্বধর্মের প্রতি সহনশীল বলেই জানে। আগে উগ্রবামপন্থী রাজনীতি করলেও বাকি বামপন্থীদের মত (হিঁদু) ধর্মের প্রতি চরম বিদ্বেষ কোনোকালেই ছিল না। আমি নিজে সমাজে এখনও নিজেকে হিঁদু বলেই পরিচয় দিই, এবং কতকটা গর্বের সাথে যে দিই না, তা বললে মিথ্যাই বলা হয়। ইদানিং কিঞ্চিৎ ইতিহাস (বা বলা ভালো, যে ৩ ধারার ইতিহাস বর্তমান ভারত তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচলিত, সেই ৩ ধারার ইতিহাস) চর্চার পরে বরং, ইব্রাহীমিয় ধর্মগুলির প্রতিই কিঞ্চিৎ রক্ষণশীল হয়ে উঠেছি। 

তা বেশ কিছুদিন আগে, নাসার উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে তোলা ব্রহ্মাণ্ডের কিছু ছবি বার হয়, যেগুলো কিছু কোটি বছর অন্তত পুরনো। তাতে সামাজিক মাধ্যমে হুলুস্থুল কাণ্ড, যে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব নাকি প্রমাণ হয়ে গেছে। সেখানে এত সব জ্ঞানী গুণী যুক্তিশালী বামপন্থী (মানে সিপিএম) লোকজন, যে নিজেরই মস্তিষ্কগঠন নিয়ে প্রশ্ন জাগে। মানে হঠাৎ ব্রহ্মাণ্ডের ছবির সাথে ঈশ্বরের কী সম্পর্ক, তাইই বুঝলাম না, তায় আবার ঈশ্বরের প্রমাণ! 

ত যাই হোক, ক’দিন আগে মুঘল ইতিহাস আর দারউইনের তত্ত্ব এক শ্রেণীর পাঠ্যক্রম হতে বাদ পড়ায় আবারও এক জিনিস হয় - সরকার চায় না যে পড়ুয়ারা দারউইনের তত্ত্ব জানুক, কারণ দারউইনের তত্ত্ব নাকি ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করে। যুক্তিবাদীরা হয়ত দৈনন্দিন জীবনে বিবর্তনবাদ ধুয়ে চা বানান, আমার অবশ্য চা পাতা হলেই চলে। আমি ত বলব বরং এসব বাদ দিয়েছে বেশ করেছে! তার বদলে ইস্কুলে জলবায়ু পরিবর্তন, বা কী পদ্ধতিতে গরমের সাথে মোকাবিলা করা যায়, সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট এবং জামাকাপর তৈরি, কৃষিবিদ্যা, এমন কি রান্না করা, এইসব পড়ালে বাচ্চাগুলোর মস্তিষ্ক বৃদ্ধি পাবে এবং সাথে সাথে কাজেও লাগবে এ-বিদ্যা। বলা বাহুল্য, দারউইনের তত্ত্বের বিরোধ করছি না আমি, বা এও বলছি না যে তা আজকের দিনে অপ্রাসঙ্গিক। আমার বক্তব্য শিক্ষাব্যবস্থাজনিত।

আমাদের দেশে আজও শিক্ষার প্রয়োগ সেই মান্ধাতার আমলের, অবশ্য মান্ধাতা রাজার আমলে হয়ত ভারতের শিক্ষা দেখার মত ছিল। এখনও একই জিনিস বছরের পর বছর ধরে পড়ান হয়। ষষ্ট থেকে দশম শ্রেণী অবধি সেই একই লাইট, একই সাউণ্ড। এখনও আমাদের সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস পড়ান হয়। পড়ান হয় যে মহাভারত রামায়ণ সব রূপকথা (সত্য মিথ্যে তর্ক সাপেক্ষ, এবং এখানেই ক্রমশ প্রকাশ্য)। ভারতীয় ধারার ইতিহাস বা যে পদ্ধতিতে ভারতীয় ইতিহাস নথিভুক্ত করা হয়েছে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই। আর সরকারেরও বলিহারি; হিঁদু রাষ্ট্র বানাতে চাইলে ভারতীয় শিক্ষার বিকাশ কর, তা নয় পাঠ্যক্রম থেকে এটা সেটা বাদ দিয়ে চলেছে। তবুও রোমিলা থাপার প্রমুখেরা যে ইদানীং সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস ছেড়ে ভারতীয় ধারার চর্চা করছেন, তা দেখে ভাল লাগে। তাতে অন্ততঃ ধারাটার বিকাশ ঘটবে, ইতিহাসের উন্মোচন হবে।

বেশ ক’দিন আগে ফেবুতে একটি দল যার নাম বিজ্ঞানকথা - সেখানে প্রায়ই যাকে বলে আনাব-শানাব জিনিস ছাপিয়ে তার মন্তব্যে ফালতু তর্ক হত এবং সেখানে রোজই “প্রমাণ করা হত” যে ধর্ম, দেবতা, আধ্যাত্মিকতা, যোগ, তন্ত্র সমস্ত কিছু অবৈজ্ঞানিক। শুরুতে মজা লাগতো তর্ক দেখতে, কিন্তু ক্রমে তা এত বোকাবোকা হয়ে ওঠে যে একদিন আমিও একটা ছাপাতে মন্তব্য করতে বাধ্য হলাম। উদ্দেশ্য, এই তথাকথিত বৈজ্ঞানিক (অ)যুক্তিবাদীদের ঘটে খানিক যুক্তি স্থাপন করা। মন্তব্যটা ছিল এইরূপ যে, এই দলে অনেকেরই স্বভাব যুক্তিপূর্ণ ত নয়ই, বরং শুধুমাত্র ধর্মকে ছোট করা এবং “বিজ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ”, এই নিয়ে গর্ব করা। তাদেরকে সাবধান করতে চাচ্ছিলাম যে তাদের বিশ্বাস বিজ্ঞানবাদ (scientism)এর দিকে। এ ছাড়া, বিজ্ঞানের পশ্চিমী এবং ভারতীয় ধারণার মধ্যে ফারাক, তথা বিজ্ঞানের আসল দর্শন এবং সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণার মধ্যে ফারাক, ধর্ম ও ধর্মচারণ (religion)এর মধ্যে ফারাক, এবং ধর্ম এবং বিজ্ঞান তথা দর্শনের সম্পর্কও উল্লেখ করেছিলাম। খানিক বাদে দল থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। যাক গে সে ভালো কথাই। 

এবার আরেকটা ঘটনায় আসি, বছর খানেক আগেকার। তখন আমি কলকাতায়। একদিন র‍্যাপিডোর এক মহামেডান (কারণ সে নিজে এইভাবে পরিচয় দিলে) ভাইয়া হঠাৎ আমাকে বলে যে আমাকে দেখে নাকি বেশ ধার্মিক বলে মনে হয়। জানি না। আসলে পাঞ্জাবী পরে মাঞ্জা দিয়ে দিদির বাড়ি যাচ্ছিলাম ফোঁটা নিতে। তো সে যাই হোক, সে আমাকে বললে “কিছু মনে না করলে তোমাদের ধর্ম নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।” তা ভালো কথা মস্তিষ্করক্ষাকবজ পরার অস্বস্তি যদি ধর্মবাচন শুনে খানিক এড়ানো যায়, তা’লে মন্দ কী! মুদিয়ালির মোড়ে একটা কালীপুজোর আয়োজন দেখিয়ে আমারে জিগালে, “এইটা কোন ঠাকুর?” আমিও বললেম যে উহা শ্যামা কালী। ত সে এবার জিগালে “পুজো কী?” আমি বললেম। সহজ করেই বললাম জটিল তন্ত্র মন্ত্র যজ্ঞ বাদ দিয়ে (আহা! সেসব কচলানোর যেন আমার কত অধিকার!)। তাদের ধর্মের বিষয়ে খুব বেশি জানা না থাকলেও হালকা বলার চেষ্টা করলাম যে আমাদের মন্ত্রের ব্যাপারটা তাদের নামাজ পরার মতই - মন্ত্রোচ্চারণের সময়ে বা নামাজ পরার সময়েও উচ্চারণ হেতু শরীরে একধরণের গুণবর্ধক শক্তির সৃষ্টি হয়।

সে মিচকি হেসে বললে, “দেখ আমাদের সব রীতিগুলোই মানুষের ভালোর জন্য। এগুলো অভ্যেস করলে কখনও কারো খারাপ কিছু হবে না, বরং ভালই হবে। কিন্তু, এই যে ঠাকুর যাকে বলছ, বা পুজো আচ্চা, এসব এল কোথা থেকে! মানে যেমন ধর, আমাদের কুর’আনে বলা যে এমন কর না, এমন করলে নরকে যাবে… ত সেটা আমরা জানছি কুর’আন থেকে যে কী করা উচিত, কী করা উচিত না। তোমরা কী করে জানছ?” ত আমি বললাম আমাদের এরম এটা ঠিক ওটা ভুল কিছু নেই। কিছু জিনিস আমরা আদি থেকে জেনে আসছি, ব্যস্‌। আমাদের ঠিক ভুলের অঙ্কটা জটিল। তার চেয়ে আমাদের কর্মফলের তত্ত্ব অনেক সহজ। “তুমি কিছু মনে করো না আমি এরম বলছি বলে। আমি কিন্তু ভুল কিছু বলছি না, আমরা একটু যুক্তি দিয়ে দেখি। এই ধরো, তোমাদের মরে যাওয়ার পরে পুরিয়ে দেওয়া হয় কেন?” আমি এটা ঠিক জানি না, কবে থেকে হিঁদু সমাধীর বদলে মৃতদেহ সৎকারের জন্য পোরানো আরম্ভ হয়েছে, বা কী করে। তাই তাকে বললাম যে এই ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে দাফন করার রীতি আমার বেশি পছন্দের। ভুল করে এও বলে ফেললাম যে এমনটা যদিও বাড়িতে বলি, ঝামেলা লেগে যাবে।

“আমার একটা ধারণা যে তোমাদের ধর্ম নিয়ে তোমার খুব একটা পড়াশোনা নেই।” বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের ধর্মে এতকিছু আছে পড়বার জানবার ভাববার, যে ‘খুব একটা পড়াশোনা’ করাও বোধ হয় এক জীবনে সম্ভব না। “আমার কেন মনে হলো বলি, তোমার যদি পড়াশোনা থাকতো তাহলে এমনটা বলতে না যে বাড়িতে বললে ঝামেলা হবে।” দিয়ে সে এক মহাপুরুষের সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে আমাকে মানে বললে, “আমাদের উৎস মাটি থেকেই…” এরম জাতীয় কিছু। “তারপর ধরো, এই যে বললে কী, কালী ঠাকুর, কোথা থেকে এলো। এত মূর্তি, কতগুলো ঠাকুর, কোনটা আসল? একটাও কি আসল? এরা ইশ্বর হতেই পারে না।”


ভিন্ন সব দেবদেবীর কথা বলে হালকা করে হিঁদু বংশতালিকার কথা বোঝাতে চেষ্টা করলাম। বুঝলো না দেখে দেবদেবীরা যে এক একটা বা একাধিক দোষ-গুণের দ্যোতক এবং মূর্তি গুলো এই দোষ-গুণেরই প্রতীক, এবং এইসব পুজো ব্যাপারটা যে একটা সামাজিক রীতি, তাও বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে বুঝলে না, বরং শেষে যা বললে, তাতে আমার পুরো মেজাজটা চটকে গেল। সে বেডা জাকির নায়কের ভাবশিষ্য। আমাকে নামিয়ে সে জাকির নায়ক কিভাবে ‘হিঁদুদের সবচেয়ে বড় তাত্ত্বিক’ শ্রী শ্রী রবিশঙ্করকে (চেটে) ফাক করে দিয়েছে, সেই ভিডিও দেখতে বললে। মানে অসাধারণ! আমার পাল্লায়ই এইসব পড়ে।

এবার আরও একটা ঘটনায় আসি। কিছুকাল আগে ইসরোর কেউ একজন বলেছে যে, যে বিজ্ঞানের সাধণা বৈজ্ঞানীকরা পরীক্ষাগারে করেন সেসব অনেক তত্ত্বই বেদে আছে। তা ভালো কথা, কী আছে না আছে সে তর্কে না হয় গেলাম না। সামাজিক মাধ্যমে এই নিয়ে তুলকালাম। ত এরম একখান ছাপা চোখে পড়ল, আদতে মেঘনাদ সাহার কোনো লেখার অংশ। মূল বক্তব্য এরম যে তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বেদে তার গবেষণা, নিউটনের গবেষনার কোনোরকম প্রমাণ পাননি।

তার মানেই কি প্রমাণ হচ্ছে যে বেদে সে বিষয়ে কিছু নেই? আদতে যেটা প্রমাণ হচ্ছে তা হল যে উনি খুঁজে পাননি। না খুঁজে পাওয়ার কী কারণ? কিছু থাকলে নিশ্চয়ই খুঁজে পেতেন না কি?

আচ্ছা, এবার আমি যদি চাই, আমি কী এখনই একটা গবেষণা করতে পারব কোয়ান্টম ফিজিক্সের একটা যে কোনো বিষয় নিয়ে? সোজা উত্তর হচ্ছে না। কারণ আমি সেই বিষয়ে অবগত নই। কিন্তু একটা বই ত পড়তে পারি না কি? হ্যাঁ, যদি পাঠ্য বই হয়। গবেষণা ধর্মী বই, বা গবেষণার কাগজ পত্র কি পড়তে পারব? সম্ভবত না, কারণ তা পড়ে সনাক্ত করবার জন্য যে শিক্ষা প্রয়োজন, তা আমার নেই। তা আমি একটা পাঠ্য বইই পড়লাম, এবং পড়ে বললাম যে কোয়ান্টম ফিজিক্স আমার নখদর্পণে, এতে বিবর্তনবাদ প্রসঙ্গে কিচ্ছুটি নেই। তাহলে কেমন হয় বিষয়টা? 

মেঘনাদ সাহার বেদ পড়াও এই একইরকম। আসলে পড়লেই ত হল না, তার মানে সনাক্ত করতে হবে। কেন ঋক্‌বেদের প্রথম সুত্রে অগ্নিবন্দনা, বোঝবার জন্য পৃথিবীর আদি ইতিহাস থেকে শুরু করতে হবে। মানে যোগ বিয়োগ পারি না আমি গেলাম পাটিগণিত করতে, বাঃ রে বিজ্ঞানী আমার!

অবশ্য বিজ্ঞান নয়, প্রমাণবাদীদের সমস্যা এটা। সবকিছুর প্রমাণ চাই তাদের। যদি নম্বরে হয়, তা’লে ত কেল্লা ফতে পুরো। গোটা বিশ্বটা তাদের কাছে স্রেফ কয়েকটা প্রমাণ - যেগুলো কিনা কিছু বিশেষ বিশেষ প্রক্রিয়াকে বর্ণনা করে। যার প্রমাণ নেই, তার অস্তিত্ব নেই, এরম একটা বিষয়। মাথায় রাগ চরা সত্যিই মাথায় মানে মস্তিষ্কে রক্তের চাপ, প্রেম শুধুই মস্তিষ্কের কয়েকটা বৈদ্যুতিক যোগসূত্র, রসায়নিক নির্যাস আর লিঙ্গে রক্তের চাপ। মানে পাণ্ডুরা প্রেমে ব্যর্থ, বা হয় ত মাথায় আঘাত লাগা মুমূর্ষু ব্যক্তিও তাই। তাদের জন্য প্রেম, ভালোবাসা, প্রজনন, সব এক।

যারা ফুকো পড়েছে জানে, যে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা মানুষের দেহকে কেবল কয়েকটা লক্ষণের সমাহার হিসাবে দেখে - কয়েকটা নম্বর। এই নম্বরগুলো ঠিক না থাকলেই আপনি অসুস্থ। তখন ওষুধ দিয়ে এই নম্বরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেগুলো ঠিক হলেই আপনি সুস্থ। একজন ব্যক্তি যদি কোন ব্যাধি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে যায়, তার লক্ষণগুলোই প্রথমে পরিমাপ করা হবে একাধিক পরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষার ফলে ধরা যাক তার রক্তশর্করার নম্বরে সমস্যা দেখা দিয়েছে - স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। তখন সেই নম্বর নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তাকে একটা ওষুধ দেওয়া হল। এবং ওষুধ চলার ক’দিন বাদে আবারও পরীক্ষা - তাতে দেখা গেল, হ্যাঁ, ওষুধে কাজ দিয়েছে, কিন্তু এইবারে তা আবার স্বাভাবিকের চেয়ে কম। এবার তার ওষুধের মাত্রা বদল করে দেওয়া হল। কিন্তু শুধু এইই নয়, এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, তার বৃক্কের সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসক বললে হ্যাঁ, এটা হওয়া স্বাভাবিক, এই ওষুধটার জন্য এরম হয়। লেকিন কই পরোয়া নহি, আমি বৃক্কের জন্য আরেকটা ওষুধ লিখে দিচ্ছি। 

ছোটবেলায় আমরা হোমিওপ্যাথি করতাম। মুক্তদলের কাছে একজন অসামান্য চিকিৎসক আসতেন - তখনই তাঁর বয়স ছিল ৮০/৯০। তাঁর কাছে এই ব্যক্তি গেলে, তিনি প্রথমে নাড়ি দেখবেন। তারপরে ওষুধ ত দূর, রুগিকে বকা দিয়ে বাড়ি পাঠাবেন এই বলে - তোকে কতবার বলেছি বেশি ভাত খাবি না! সবজি খাবি বেশি করে, ভাত রুটি কম খাবি। হোমিওপ্যাথিকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান পছন্দ করে না, তার কারণ আধুনিক চিকিৎসার মত হোমিওপ্যাথি কিংবা আয়ুর্বেদ প্রমাণভিত্তিক না। হোমিওপ্যাথি কাজ করে মূলত বিশ্বাস, এবং মানসিক বা মনোভাব রূপান্তর নিয়ে, এবং দৈনন্দিন কিছু সাধারণ অভ্যাসের ভিত্তিতে। আয়ুর্বেদ পুরোপুরি ভেষজ। এখানে বলতে চাই যে আমার পা ভেঙে গেলে হোমিওপ্যাথি বড়ি অবশ্যই তার চিকিৎসা করতে পারবে না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আয়ুর্বেদিক ভেষজ দিয়ে (বা হমিওপ্যাথিক বড়ি দিয়ে) আমার ব্যাথা বা ব্যাথার অনুভব কমানো যাবে না। সমস্ত কিছুর প্রয়োগে একটা প্রসার আছে, যাকে বলে স্কোপ। এসব বলার অর্থ এই, যে এই “অবৈজ্ঞানিক” চিকিৎসাবিদ্যার সাথে ঈশ্বরের বিশেষ মিল আছে। আর ওদিকে আধুনিক চিকিৎসার সাথে মিল আছে পশ্চিমী বিজ্ঞানের। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণসাপেক্ষ নয়, বিশ্বাসসাপেক্ষ। ঈশ্বরের প্রমাণ খুঁজতে যাওয়া আর ঘোড়ার ডিম, বিষয়টা একই রকম। কিন্তু প্রমাণ নেই মানেই যে তা অবান্তর, বা অপ্রাসঙ্গিক এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং, প্রমাণ থাকলেই যে তা একেবারে দৃঢ় সত্য, এমনটাই আদতে নয়।

এরম এক তত্ত্বের উত্তরে হ্যানসন লিখেছিলেন যে যে কোন প্রমাণ, বা পর্যবেক্ষণ, সে বৈজ্ঞানীক হোক, বা না হোক, আদতে আমাদের চেতনা দ্বারা কলুষিত। এক ব্যাক্তি কখনই তার ধারণাগত কাঠামোর ঊর্ধ্বে উঠে ‘অব্জেকটিভ বিবেচনা’ দিতে পারে না। এবং ভারতীয় ইতিহাসের তথ্যসমূহ এতই গুপ্ত ভাবে অতিবাহিত, যাকে বলে ‘ক্রিপটিক’, একজন সাধারণ ব্যাক্তির পক্ষে (বা মেঘনাদ সাহার পক্ষে) তা সনাক্ত করে মানে বার করা অসম্ভব। অর্থাৎ তিনি ফিজিক্সের কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝবেন, সেটা যেমন আমি বুঝতে গেলে, আমায় ফিজিক্সের খুঁটিনাটি বুঝতে হবে, তাঁকেও বেদ পড়ে কিছু বোঝার জন্য বেদের খুঁটিনাটি সমস্ত রপ্ত করতে হবে। যুক্তিবাদীদের দায়িত্ব যুক্তিসাপেক্ষ আলোচনা করা। না জানা, বা না বোঝার থেকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব। ঈশ্বরের বোধ মনুষ্য প্রবৃত্তি ছাপিয়ে অহংকে উত্তোলিত কোন উঠোনে নিয়ে যায়। বিজ্ঞানের সাথে ঈশ্বরের কোন শত্রুতা নেই। বিজ্ঞানই বরং ইশ্বরকে বোঝার উপকূল পদ্ধতি। লোকে মনে করেন যে বিজ্ঞান ইশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য বসে আছে। আদতে বিজ্ঞানের বিন্দুমাত্র মাথাব্যাথা নেই এসব নিয়ে। ঈশ্বরও বসে নেই যে কবে বিজ্ঞান তাকে প্রমাণ করবে, সেই আশায়। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শিল্পী, শিল্পায়ন, প্রেম এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গে