শিল্পী, শিল্পায়ন, প্রেম এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গে

“কীভাবে একজন কবি শুনতে পান তার নিজের কবিতাকে? কোন ছন্দ থাকে 
তার মাথার ভীতরে, কী ভেবে তিনি লাইন সাজান, যতিচিহ্ন রাখেন, অথবা বর্জন করেন?”


লাইনগুলি থেকে থেকেই মনে পরে, আর ভাবিয়ে তোলে, কবি কি সত্যিই কবিতা তৈরি করেন, নাকি কবিতা তাঁর কাছে ধরা দেয় মাত্র? কবি ছাড়া কি কবিতার কোন অস্তিত্ব নেই? বার্থের মতে শিল্পায়নের পরে শিল্পীর মৃত্যু ঘটে - শিল্পের তখন এক স্বাধীন অস্তিত্ব কায়েম হয়; শিল্পীর অভিপ্রায় আর সেই শিল্পের মধ্যে খাটে না। সৃষ্টির আদিতে প্রজাপতি তপস্যাক্রমে নিজ দেহ হতে এক কায়া বাহির করেন। নিজসৃষ্টির সুঠাম রূপৌজ্জ্বলতার বশে তাঁকে ভোগ করবার বাসনা করেন স্বয়ং ব্রহ্মা। পুত্ররা পিতালালসার ছিঃ ছিঃ করলেও সরস্বতীর স্বরূপে তিনি মোহাবিষ্ট।


সৃষ্টিশীল সমস্তই জগতে বর্তমান। তবে কি শিল্পীকে সৃষ্টিকর্তার উপাধি দেওয়া ঠিক? একজন শিল্পী তাঁর শিল্পসত্ত্বা প্রয়োগ করে সমস্ত থেকে বাছাই করেন মাত্র। শিল্পীর মাধুর্য তাঁর রূপ-প্রদানের ক্ষমতায়। এই সত্ত্বা বা শিল্পতত্ত্ব লাভ করবার জন্য বাকদেবীর আশীর্বাদ কাম্য। এই সাধনাদ্বারাই প্রজাপতি ব্রহ্মা সৃষ্টিতত্ত্ব লাভ করে সৃষ্টিকর্মে রত হয়েছেন। বীণাপাণি ব্যতীত এই কর্মে সফল হওয়ার কোন উপক্রমই ছিল না তাঁর। প্রতি ক্ষেপে তিনিই পথ দেখিয়েছেন - তিনিই পথ দেখান। এই মিথুনের বশেই সৃষ্টিকর্ম চলে, এতে করেই শিল্পীর শিল্পচর্চা সক্ষম হয়। সরস্বতি ব্রহ্মার স্বরূপ-মাত্র। তিনি হতেই তাঁর উৎপত্তি, এবং তাঁর সহিত প্রেমের বশেই সৃষ্টিকর্তার ইশ্বরলাভ। সফল শিল্পকর্মের পরে শিল্পীরও ইশ্বরলাভ ঘটে।


তবে সে নেহাত মুখের কথা নয়। একজন শিল্পী কি সহজে নিজের কাজে মুগ্ধ হয়? অনেকে হয় বইকি, তবে সেটাকে নিশ্চিতিকরন ব্যাধি বলা চলে। আদতে যদিও শিল্পীর তত্ত্ব তাঁর অজান্তেই তাঁকে বশ করানোর চেষ্টা করে, তবু, অনেকেই সরস্বতীর প্রভাব অস্বীকার করে ঔদ্ধত্যের প্রকোপে শিল্পকর্মে উদ্যত হন। কাজেই শিল্পী হওয়ার আগতে নিজের ঔদ্ধত্য নিয়ন্ত্রণ করবার প্রক্রিয়াই সাধনারূপে বর্ণিত। পাসোলিনির মতে যে শিল্প মানসচক্ষে ভাসমান, তাহাকে ভৌতিক রূপ দেওয়াই শিল্পীর প্রধান কর্ম - ইহাই শিল্পায়ন। কিন্তু শিল্পের এই মানসরুপকে অশোধিতভাবে গ্রহণ করবার প্রবণতা সর্বদাই শিল্পীর মনকে প্রহত করে বেড়ায়।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ধর্মের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ধর্ম প্রসঙ্গে